অভিজাতরা কেন সালাফি হচ্ছে?
![]() |
| Mahdi Galib |
বড় ভাইর বন্ধু
তিনি। বহুজাতিক কোম্পানির বড়কর্তা। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়স। হঠাৎ করে
ইসলামমুখি হয়েছেন। দাঁড়ি
রেখেছেন। হুযুর রেখে
কোর’আন শিখছেন।
ফোনে একদিন যেতে
বললেন। গেলাম। উত্তরা
এলাকার অভিজাত বাড়ি।
কড়া নিরাপত্তা। দারোয়ানকে পরিচয় দাও, নাম
ঠিকানা লিখ। এরপর
ঢোকার অনুমতি।
বসার ঘরে অপেক্ষা
করছি। নজর পরল
বইয়ের তাকে। সারিসারি বই। তিনি সৌখিন
মানুষ। বই আগেও
দেখেছি। কিন্তু একটা
জিনিষে দৃষ্টি আটকাল।
অনেক নতুন বই
দেখছি। বলাই বাহুল্য
ইসলামি বই। কিন্তু
বিষয়টা অন্যখানে। একজন
লেখকের বই দিয়ে
পুরো একটা সেলফ
ভর্তি। নাম বলব
না। তিনি কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন
সম্ভবত। হেসে হেসে
কথা বলতেন টিভিতে।
ভারতের ফুরফুরা দরবারে
সাথে আত্মিয়তার সম্পর্ক
ছিল তার। এখন
তিনি প্রয়াত। যাহোক,
এই লেখক একজন
লামাযহাবি। স্পষ্ট করলে
ওহাবিতন্ত্রের সালাফি ঘরনা।
এসব দেখছিলাম। এরমধ্যে
আমার মেজবান এসছেন।
আলাপ শুরু হল।
কয়েক ঘণ্টা গেল।
তিনি আস্তে আস্তে
আমার প্রতি আশ্বস্ত
হচ্ছেন। নতুন তথ্য
জানাচ্ছি। তিনি অবাক
হচ্ছেন। এক পর্যায়ে
জিজ্ঞেস করলাম- দাদা,
আপনি দেখি জনৈক
অধ্যাপকের বই কিনে
ফতুর হচ্ছেন, ঘটনা
কি? তার উত্তর
এমন- আরে তিনি
তো ভালো লোক,
কী সুন্দর ব্যবহার,
হেসে কথা বলেন,
চেঁচিয়ে বক্তব্য দেন
না, আর শিরিকের
বিষয়ে সোচ্চার। কী
বলব বুঝছিলাম না।
একটা মুচকি হাসি
দিয়ে প্রসঙ্গ শেষ
করলাম।
দ্বিতীয় ঘটনা সাম্প্রতিক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
যুবক মানুষ। কয়েকটি
ব্যতিক্রম বইয়ের লেখক।
আমার ফেসবুক বন্ধু
তিনি। সেদিন নিউজফিড
দেখছিলাম। তার একটা
পোস্ট এলো। তিনিও
জনৈক অধ্যাপকের বিষয়ে
লিখেছেন। তিনি বলছেন
জনৈক অধ্যাপক নাকি
গ্রামবাংলার কুসংস্কার যুক্ত
হুজুরদের জব্বর আঘাত
হেনেছেন। তিনি নাকি
সহিহ হাদিস দিয়ে
বুঝিয়েছেন আমরা বাংলাদেশের মুসলমান কতটা অশিক্ষিত। তিনি বাংলাদেশের মুসলিমদের শিক্ষিত করার চেষ্টা
করেছেন।
এখানেও চুপ ছিলাম।
ধপ করে বলার
মত কিছু পাই
নি। এবার শেষ
উদাহরণ। আমার ভালোবাসার ইরফান ভাই। চট্টগ্রামের মানুষ। ধনাঢ্য পরিবারের। থাকেন ঢাকার অভিজাত
এলাকায়। পরশু কথা
হচ্ছিল ইনবক্সে। প্রচণ্ড
বিমর্ষ পেলাম। কারণ
জিগালাম। এরপরে তার
বক্তব্যের সারমর্ম তুলে
ধরছি। বললেন-
চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষিত
সুন্নি পরিবার মসজিদ-মাদ্রাসা চালায়।
কিন্তু যাদের ঘরে
আলেম নেই এদের
প্রায় সবাই সুন্নিয়াত থেকে বেরিয়ে গেছে।
সোজা কথায় ওহাবি
হয়ে গেছে। এখন
শুধু কালচারের কারণে
সুন্নি প্রতিষ্ঠান, গাউসিয়া
খতম ইত্যাদি প্রোমোট
করছে। ধনী সুন্নিদের ওহাবিরা কব্জা করছে।
চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম
ঘুরে গত কয়েক
বছরে সবদিকে একই
অবস্থা দেখলাম। এদের
মধ্যে ধনাঢ্য পরিবারের পিছে পিছে কয়েকটা
সুন্নি আলেম ঘুরে।
কিন্তু ওহাবিবাদী কথাগুলার কোনো প্রতিবাদ করে
না। আজকে এক
অনুষ্ঠানে গিয়েছি। এক
বুড়া হুজুরকে দেখলাম।
সে নাকি শেরেবাংলা হুজুরের সাথে একখাটে
ঘুমিয়েছে। অনুষ্ঠানে কিছু
সালাফিও ছিল। সালাফিরা আলাপ উঠিয়েছে যে
শিক্ষিত হয়ে কেউ
পীর-মুরিদি কীভাবে
করে? এটা মূর্খদের কাজ। সে বুড়া
হুযুর একটা কথারও
প্রতিবাদ করে নি।
টাকার জন্য গেছিলো
এক সওদাগরের কাছে।
জানেন ভাই, জামেয়া
মাদ্রাসার পাশের মহল্লাতে এখন ওহাবি মাদ্রাসা। জামেয়ার পাশের মহল্লার
নতুন মসজিদ সবগুলোতে ওহাবি ইমাম। (এ
পর্যায়ে একজন শিল্পপতির নাম নিলেন) সূফি
সাহেবের খেদমতগুলো থেকে
লংটার্মে সুন্নিয়াতের কী
লাভ হচ্ছে বলেন?
সুন্নি কমিটিগুলো কি
পারে না তার
সাথে বসে মাস্টারপ্ল্যান করতে?
সে খরচ তো
কম করছে না।
এসব নিয়ে ভাবে
না সুন্নিরা। আমার
নানাবাড়ির গ্রামে ওহাবিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা
যেতো না। সেখানের
মসজিদে দেখি আজকাল
একটা ছেলে বুকে
হাত বেঁধে নামাজ
পড়ে। একবারে সালাফি
হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলছিলেন। থামিয়ে দিলাম। সহ্য হচ্ছিল
না। চিন্তায় মাথা
ব্যথা শুরু হল।
এরকম হাজার উদাহরণ
আছে। কিন্তু কেন
এমন হচ্ছে? শতশত
বছর ধরে লালন
করা সূফিধারা ও
সুন্নিয়াত থেকে কেন
অভিজাত শ্রেণি নাক
সিটকাচ্ছে? ভেবেছেন!
কারণ জানতে হলে,
আগে অভিজাতদের সাইকোলজি বুঝতে হবে। যাদের
বুনিয়াদী বংশ, অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে,
উচ্চশিক্ষিত সমাজ- এরাই
অভিজাত শ্রেণি। অভিজাতরা সৌন্দর্য পছন্দ করে।
কোটি টাকার ইরানি
কার্পেট পায়ের তলায়
বিছায়। কাশ্মীরি গোলাপ
না পেলে লাখ
টাকার কাগজের গোলাপে
ঘর সাজায়। মানে
এরা পরিচ্ছন্ন থাকতে
চায়। শুধু ঘর
সাজানো না- সামাজিকতা, মেলামেশা, এমনকি ধর্ম
পালনেও। এরা স্বাধীনচেতা, যুক্তিবাদী হয়। হুযুর
যাই বলবে তাই
মানার প্রবণতা নেই।
হুজুরের কথার সাথে
নিজের চিন্তা মিশাবে।
এরপর সিদ্ধান্ত নিবে।
এদের সংস্কৃতি ভিন্ন।
গ্রামের হত দরিদ্র
সমাজ হুজুরের সুরেলা
ওয়াজ ঘন্টঘন্টা শুনবে।
কিন্তু অভিজাতদের অত
সময় নেই। এরা
ধর্মকে জীবনের একটা
অংশ মনে করে।
পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ভাবে না। আপনার-আমার মত
সময় নেই তাদের।
এরা ধর্মকে একটা
রিচুয়াল বা ধর্মানুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ভাবে। তাই শর্টকাট
ইসলাম খুঁজে।
আর এখানেই সুন্নিরা পরাজিত। বাংলাদেশে ওহাবি
বিপ্লবের পিছে ওহাবি-সালাফিদের অবদান
খুব কম। পুরো
অবদান সুন্নিদের নিজের।
আমরা স্কলারি বা
পাণ্ডিত্য সুলভ কথা
বলি না। সমাজ-স্থান বুঝি
না। মাইক পেলেই
দেই টান। চেঁচামেচি আর বক্তব্যের গরমে
ময়দান উতালা করি।
কিন্তু অভিজাতরা তথ্য
চায়, যুক্তি চায়।
আবেগ তাদের খুব
সহজে তাড়িত করে
না।
গুলশানে এক কোটিপতির বাসায় অনুষ্ঠান। ঈদে
মিলাদুন্নাবির (দ) অনুষ্ঠান। আমি উপস্থাপক। এক
হুযুর এসেছেন। তিনি
নাকি টিভি-রেডিওতে
কাজ করেন। বক্তব্য
শুরু করল। হায়
খোদা! বিশ মিনিটের
জায়গায় এক ঘন্টা
টানলেন। কোনো তথ্য
নেই, উপাত্ত নেই।
সুরের ঠেলায় মাইক
ছেঁড়ার অবস্থা। শ্রোতারা বিরক্তির চরমে। ভদ্রতা
করে উঠে যাচ্ছে
না শুধু।
একবার ভাবুন তো,
যে লোক এ
বছর বিরক্ত হয়ে
ফিরলেন, তিনি কি
আগামী বছর আসবেন?
না, আসবে না।
এটাই বাস্তবতা। আর
এখানেই ওহাবি-সালাফিরা সুযোগ নেয়। এরা
রেফারেন্সের ভেল্কি দেখায়।
নিজেকে আধুনিক সাজায়।
আর সঙ্গত কারণেই
অভিজাতরা তাদের দিকে
ঝুঁকে। অভিজাতদের অত
গবেষণার সময় নেই
যে ওহাবি, কে
সুন্নি। হুযুর হলেই
হল। এরপর হুযুর
যদি হয় মডার্ন,
আধুনিক মুখোশের- তাহলে
কথাই নেই।
অভিজাত ও শিক্ষিতরা সংস্কারবাদী হয়। নিজেকে
সামগ্রিক সমাজ থেকে
আলাদা ভাবে। কেউ
নতুন কিছু করলে
আগ্রহ দেখায়। এটা তাদের
অবচেতন বা সাবকন্সেস সাইকোলজি। আর এখানেই
সুন্নিরা ধরা খাচ্ছে।
সুন্নিদের নতুনত্ব, নবায়ন
নেই।
সুন্নিরা মাজারকেন্দ্রিক ব্যবসার
যথার্থ প্রতিবাদ করে
না। সুন্নি নামধারী
ভন্ডদের যথেষ্ট প্রতিহত
করে না। ওহাবিদের গালি দেয়, কিন্তু
মানুষকে গঠনমূলক ভাবে
বুঝায় না ওহাবি-সালাফিদের মৌলিক ত্রুটি কোন
জায়গাতে। কালচার না
বুঝে কথা বলা
সবচে বড় সমস্যা।
আর একজন আলেমের
সবচেয়ে বড় দায়িত্ব-
দুষ্টের দমন শিষ্টের
পালন। এটা করছে
না। সুন্নিরা কেমন
নেতিয়ে গেছে। শেরেবাংলার সেই বিপ্লবী চেতনা
এখন মরচিকার মত।
মূলত এসব কারণেই
অভিজাতরা সুন্নিদের দেখলে
নাক সিটকায়। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ভাবে। সহজ
ভাষায় ফিকিন্নির জাত।
অথচ সূফিরাই সবচে
অভিজাত পরিবার থেকে
এসেছে, আসে। বাবা
শাহজালাল, শাহ আমানত,
মাখদুম রূপস এভাবেই
সব আউলিয়াগণ সবচে
অভিজাত পরিবার থেকে
এসেছেন।
এমনকি মাদানি যুগে
দেখুন। প্রথম দিকের
সাহাবিরা বেশীরভাগ অভিজাত।
হযরত আবু বকর,
হযরত ওসমান, মওলা
আলী, মা খাদিজা-
তাঁরা সবাই সমাজের
সবচে সম্মানিত পরিবারের। ইতিহাসের শুরু থেকেই
ইসলাম প্রচারে সবচে
বেশী এগিয়েছে অভিজাত
শ্রেণি।
শিক্ষিত সমাজের দিকে
দেখুন। শিক্ষিতরা শুধু
কুষ্টিয়ার সেই অধ্যাপকের দিকে ঝুঁকে কেন? আমাদের কি
কেউ নেই! ঢাবি,
চবি, শাবিপ্রবি, জবি
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক
অধ্যাপকদের চিনি। যারা
অনেকেই বিভাগীয় প্রধান।
আপাদমস্তক সুন্নি। তাঁরা
এগুচ্ছেন না কেন?
আলেম সমাজ করছেন
কি? দোহাই আপনারা
বদলান। স্মার্ট হন।
সোসাইটি ও কালচার
বুঝুন। মানুষের ভাষায়
কথা বলতে শিখুন।
সাইপ্রাসের নাজিম হাক্কানিকে দেখুন। তাঁর ডেপুটি
হিশাম কিব্বানিকে দেখুন।
তাঁরা সূফি হয়েও
চূড়ান্ত আধুনিক।
শুধু সামাজিক আন্দোলন
দিয়েই হবে না।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণও সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া দরকার।
দাওয়াতি কার্যক্রম বেশী
দরকার সুন্নিদের। পড়াশুনা
বাড়ানো ওয়াজিব হয়ে
গেছে। সুন্নিদের গবেষক,
লেখক, কবি, বক্তা,
রাজনীতিক, শিক্ষক, প্রশিক্ষক- শ্রেণি গড়ে তোলা
এখন ওয়াজিব। এর
সাথে মানবিক কার্যক্রমে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে
হবে।
এসব যদি না
করি, যেভাবে চলছে,
সেভাবেই যদি চলে-
খুব বেশী দিন
নেই, যখন সুন্নিরা বিরলপ্রাণি বা এলিয়েনে
পরিণত হবে। বর্তমানেই তো সুন্নি-সূফিরা
এদেশে হিন্দুদের থেকেও
সংখ্যালঘু।
সামনে দিন,
আরো আসছে কঠিন।
মনে রাখবেন- নিজে
না চাইলে আল্লাহ্ও ভাগ্য পরিবর্তন করে
না।

কোন মন্তব্য নেই